৪. হুদায়বিয়ার সন্ধি :
রাসুল সা. ৬২৮ খৃষ্টাব্দে মক্কায় গমনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এবং ১৪০০ সাহাবী নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। বুদাইল বিন ওরাকার নিকট কুরাইশদের যুদ্ধাভিযানের কথা শুনে মক্কার নয় মাইল অদূরে হুদায়বিয়া নামক স্থানে শিবির স্থাপন করেন।কুরাইশদের পক্ষ থেকে ওরাকা বিন মাসুদ সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে আসেন।মুসলমানদের পক্ষে হযরত ওসমান (রাঃ) সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে পাঠান। মুসলিম শিবিরে হযরত ওসমান হত্যার রব উঠে।এতে মুসলমানগণ ক্ষুব্ধ হইয়া শফথ করে যে,ওসমান হত্যার প্রতিশোধ না নিয়ে তারা ফিরে যাবেনা। মুসলমানদের এই ঘোষনা শুনে কুরাইশরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠে এবং সাথে সাথে সুহাইল বিন আমরকে সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে পাঠায়। ইতিহাসে এটা হুদায়রিয়ার সন্ধি নামে পরিচিত।
সন্ধির প্রধান প্রধান শর্তগুলো হলো –
১. ৬২৮ খৃষ্টাব্দে মুসলমানদের হজ্জ না করেই মদীনা ফিরে যাবে।
২. দশ বছর সকল প্রকার যুদ্ধ বিগ্রহ বন্ধ থাকবে ।
৩. পরের বছর মাত্র তিন দিনের জন্য মুসলমানরা হজ্জ পালন করতে আসতে পারবে।
৪. মক্কায় অবস্থান কালে মুসলমানগণ শুধু মাত্র আত্মরক্ষার কোষবদ্ধ তরবারী রাখতে পারবে।
৫. কোন মক্কবাসী মদীনায় আশ্রয় চাইলে তাকে আশ্রয় দেয়া যাবেনা।
৬. কোন মদীনা বাসী মক্কায় আসলে তাকে মক্কাবাসী ফিরৎ দিতে বাধ্য থাকবে না।
৭. সন্ধির শর্তবলী উভয় পক্ষ সমান ভাবে পালন করবে ।
৫. মদীনা সনদ :
যখন মদীনাবাসীদের মধ্যে ধর্মীয় অধঃপতন ও হতাশা, সামাজিক অসন্তোষ ও কুসংস্কার এবং রাজনৈতিক বিশৃংখলা ও অরাজকতার হাত হইতে রক্ষা পাওয়ার জন্য মদীনাবাসীগণ একজন মহাপুরুষ ও ত্রানকর্তারূপে রাসূল (সা.) কে সম্মানের সাথে আমন্ত্রন করে । কারণ আউস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে ৪০ বছর ধারাবাহিক যদ্ধের কারণে মদীনাবাসীগণ সংশয়, উদ্বেগ,অস্থির হয়ে পড়ে। মদীনার এই অস্থিরতা দূর, গোত্রগুলোর ঐক্য ও সদ্ভাব প্রতিষ্ঠা করার মানষে রাসূল (সা.) একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র স্থাপনের সংকলপ করেন । আউস ও খাজরাজ গোত্রদ্বয়কে একাত্রিত করন ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করা এবং অমুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিঞ্চুতার ভিত্তিতে সহনশীলতার মনোভাব গড়ে তোলার জন্য তিনি ৪৭টি শর্ত সম্বলিত একটি সনদ প্রনয়নণ করেন। ইসলামের ইতিহাসে ইহা “মদিনা সনদ” নামে পরিচিত ।
নিম্মে উল্ল্যেখযোগ্য শর্তাবলী আলোচনা করা হলো ।
ক. মদীনা সনদে স্বাক্ষরকারী ইহুদী, খৃষ্টান, পৌত্তলিক ও মুসলমান সম্প্রদায় সমূহ সমান অধিকার ভোগ করবে। এবং তারা একটি সাধারণ জাতি গঠন করবে।
খ. রাসূল (সাঃ) নবগঠিত প্রজাতন্ত্রের সভাপতি হবেন এবং পদাধিকার বলে তিনি মদীনার সর্বোচ্চ বিচারলয়ের সর্বময় কর্তা হবেন।
গ. পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় থাকবে। কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
ঘ. কেউ কোরাইশদের সাথে কোন প্রকার সন্ধি করতে পারবে না। কিংবা মদীনা বাসীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে কোরাইশদের কে সাহায্য করতে পারবে না।
ঙ. সম্প্রদায়কে বহি:শত্রু আক্রমন করলে সকল নসম্প্রদায়ের লোকেরা সমবেত প্রচেষ্টায় তা প্রতিহত করবে।
চ. বহিঃশত্রুর আক্রমনে স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়সমূহ স্ব স্ব যুদ্ধ ব্যয়ভার বহন করবে।
ছ. কোন ব্যক্তি অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত বলে গণ্য হবে। অপরাধের সম্প্রদায়কে দোষী করা যাবে না।
জ. মদীনা শহরকে পবিত্র ঘোষনা করা হলো। এতে কোন হত্যা, রক্তপাত এবং অপরাধমূলক কার্যকলাপ চলবে না।
ঝ. অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি ভোগ করতে হবে। সর্বপ্রকার অপরাধীকে ঘৃনার চোখে দেখবে।
ঞ. ইহুদী মিত্ররাও সমান নিরাপত্তা পাবে ও স্বাধীনতা ভোগ করবে।
ট. দূর্বল ও অসহায়কে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করতে হবে।
ঠ. রাসূল (সা.) এর অনুমতি ছাড়া মদীনা বাসীগণ কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করতে পারবে না।
ড. সম্প্রদায়দের মধ্যে কোন বিরোধ দেখা দিলে রাসূল (সা.) আল্লাহর বিধান অনুসারে মিমাংসা করবেন।
ঢ. সনদের শর্ত ভঙ্গকারীর উপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হইবে।
৬. খাইবারের যুদ্ধ :
৬২৮ খৃষ্টাব্দে মে মাসে ৭ম হিজরীর মহররম মাসে এ যুদ্ধ সংগঠিত হয় । ইহুদীরা বেদুঈন গোত্রের সহযোগীতায় ৪০০০ চার হাজার সৈন্য নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ন হয় । রাসূল (সা.) ২০০ অশ্বরোহী সহ ১,৬০০ মুসলিম যোদ্ধা প্রেরণ করেন।খাইবার ও বনু ঘাতফানদের মধ্যে যাতায়াত বন্ধের মাধ্যমে তাদেরকে অবোরুদ্ধ করে রাখা হয় । দীর্ঘ দিন অবোরুদ্ধ থাকার পর ইহুদীরা আত্মসর্মপন করতে বাধ্য হয় ।
উল্লেখ্য এই যুদ্ধে আলী রা. আসাদুল্লাহ উপাদি লাভ করেন ।
৭. মুতার যুদ্ধ :
মুতার যুদ্ধ ৬২৯ খৃষ্টাব্দে (৮হিজরীর জমাদিউল উলা মাসে) সংগঠিত হয় । রাসূল (সাঃ) এর দূত হারিস বিন উমাইয়াকে মুতায় নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয় । এই হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য রাসূল সা. ৩,০০০(তিন হাজার) সৈন্যের একটি বাহিনী প্রেরন করেন । এ যুদ্ধে বিশিষ্ট তিন জন সেনাপতি সাহাবী (যায়েদ, জাফর, আব্দুল্লাহ ) শাহাদাৎ বরন করেন । এক লক্ষাধিক রোমান সৈন্যের মোকাবেলায় মাত্র ৩,০০০ (তিন হাজার)সৈন্য বিপর্যয়ের মুখে পড়লে বীরশ্রেষ্ঠ খালিদ বিন ওয়ালিদ সমূহ বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেন । বীরত্বের জন্য খালিদ বিন ওয়ালিদকে সাইফুল্লাহ উপাধি লাভ করেন।
৮. হুনাইনের যুদ্ধ :
৬৩০ খৃষ্টাব্দে ২৭শে জানুয়ারী ৮ম হিজরীতে হুনাইনের যুদ্ধ সংগঠিত হয় । মক্কার তিন মাইল দূরে হুনাইন নামক স্থানে ২০,০০০সৈন্য নিয়ে বেদুইনরা সমাবেশ করে । বীর শ্রেষ্ঠ খালিদ বিন ওয়ালিদ এর নেতৃত্বে ১২,০০০ সৈন্য হুনাইন প্রান্তরে যুদ্ধে উপনিত হয় । এই যুদ্ধে ৬০০০ সৈন্য মুসলমানদের হাতে বন্দি হয় ।
৯. তাবুক অভিযান :
এটি ছিল রাসূল (সা.) এর জীবনের সর্বশেষ অভিযান। ৬৩০ খৃষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে (৯হিজরীর রজব মাস) লক্ষাধিক সৈন্য সহ বায়জানটাইন বাহিনী মদীনার দিকে রওনা হয়। মুসলিম বাহিনীতে ১০০০ অশ্বারোহী ও ৩০০০ পদাতিক সৈন্য সহ মোট ৩০.০০০ (ত্রিশহাজার) সৈন্য ছিল। এই যুদ্ধে আবু বকর (রা.) তার সমস্ত সম্পদ দান করেন, হযরত ওমর তাঁর জীবনের অর্জিত সম্পদের অর্ধেক দান করেন, হযরত ওসমান (রা.) ও আব্দুর রহমান ইবনে আবউফ সহ সকলে বিপুল পরিমাণ সাহায্য করে,মেয়েরা তাদের গহনা খুলে নযরানা পেশ করেন। এই সময়টিতে- দেশে চলছিল দুভিক্ষ, আবহাওয়া ছিল প্রচন্ড গরম, ফসল কাটার সময় কাছে এসে গিয়েছিল, সওয়ারী ও সাজসরন্জামের ব্যবস্থা করা ছিল খুবই কঠিন। তথাপিও মোসলমানদের জন্য ছিল এটি অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন! বিধায় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর জন্য কোনভাবে পিছপা হওয়ার সুযোগ সামনে ছিল না। অবশেষে রোমান বাহিনী মুতার যুদ্ধের বয়াবহ পরিনতির কথা স্বরন করে নিজেতের সৈন্যবাহিনী গুটিয়ে নেয়। ফলে এ অভিযানে যুদ্ধের কোন প্রয়োজন হয়নি।