
কবি নজরুলের জীবনকথা (পর্ব-১১)
জুবায়ের আহমেদ জীবন
(গত সংখ্যার পর)
আজীবন রুশ বিপ্লবের আদর্শকে নিজের সৃষ্টি ও কর্মকান্ডে প্রতিফলিত করেছেন নজরুল ইসলাম। তার বিভিন্ন রচনা, পত্রিকা সম্পাদনা ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে রুশ বিপ্লবের প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে বিচিত্র মাত্রায়। ভারতে রুশ বিপ্লবের প্রকাশ্য ধারক ও বাহক কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে এই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন নজরুল। অন্যদিকে রাশিয়ার জনগণও বাংলার এই কবিকে “বিপ্লবী- প্রলেতারীয়- রোমান্টিক” কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
কবি মানে শুধু কাব্য, গ্রন্থ ও ইয়া বড় বই রচনকারী বা লেখক না। কবি মানে হচ্ছে সৃজনশীল ব্যক্তি, দার্শনিক, দেশপ্রেমিক, বৈপ্লবিক ও সমাজ সংস্কারক। তেমনি কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যিনি সমাজের নানা সমস্যা উল্লেখ করেছেন তার বিদ্রোহী ও বৈপ্লবিক কবিতা, গান, গজলের মাধ্যমে। বাংলা সাহিত্যে নজরুলের পদচারণা আজো মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিয়ে যায়। তার হৃদয় নিংরানো ভালবাস দিয়ে রচিত গান, গজল, কবিতা, উপন্যাস, গল্প গুলো। যেমনি তিনি বাগ্মী কন্ঠস্বরী লেখক ছিলেন। তেমনিভাবে নারীদের সঠিক অধিকার ও মর্যাদা দানে ছিলেন সাম্যবাদী। নারীরা যে শুধু সন্তান লালন- পালন ও গৃহপরিচারিকা তা নয়। তারা যেমনিভাবে সন্তান লালন-পালনে সচেষ্ট ও সন্তানকে বড় করতে দেন সেবা- যত্ন, তেমনিভাবেই দিতে পারেন প্রেরণা, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন গড়ার মন্র। শুধু পুুরুষেরাই জয়ী, তারাই কর্মশীল, শক্তিশালী ও রণবীর তা নয়, তাদের এই জয়ের ও বীরত্বের জন্য মূল মন্ত্র দিয়েছেন নারীরা। তাই কবি বলেছেন,
“কোন কালে হয়নি কো জয়ী পুরুষের তরবারি
প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয়া লক্ষ্মী নারী।”
শুধু পুরুষেরাই পৃথিবীর সংখ্যা গরিষ্ঠ নয়, নারীরা একটু হলেও তাদের সমমান। তিনি বিদ্রোহী ছিলেন বটে কিন্তু বিদ্রোহীতার মাঝেও তার সাম্যবাদী প্রতিভাও তিনি তার লেখার মধ্যে বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
‘ এ বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,
নারী দিলে তার রূপ- রস- মধু- গন্ধ- সুনির্মল
তাজমহলে পাথর দেখেছো, দেখিয়াছ তার প্রাণ?
অন্তরে তার মমতাজ নারী, বাইরেতে শা-জাহান।’
কবি নারীদের শীর্ষে স্থান দিয়েছেন, নারীদের করেছেন পৃথিবী গর্ভের মধ্যমণি।
কবি নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক কবি। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া এতবড় অসাম্প্রদায়িক মিলনের কবি বাংলা সাহিত্যে আর কেউ আছেন কিনা সন্দেহ। তার কবিতা ও সংগীত হিন্দু- মুসলিম সংস্কৃতির মিলনাত্মক ঐক্যবদ্ধ ভারতের এমন এক নিবিড় উপলব্ধি সঞ্চার করে দেয়, যার তুল্য ভিন্নতর দৃষ্টান্ত বাংলা সাহিত্যে দুর্লোভ। সমালোচক আজহার উদ্দীন যথার্থই বলেছেন, “একদিকে হিন্দু সংস্কৃতির মনীষা, ত্যাগ ও তপস্যা, অপরদিকে মুসলিম সংস্কৃতির তেজ ও দূর্বার সাহসের অপূর্ব মিশ্রণে যে দিব্যমানবত্বের সৃষ্টি হয়, কবি নজরুলের সাহিত্য সেই রসাদশের সাহিত্য।” (চলবে)
Post Views:
216