কবি নজরুলের জীবনকথা (পর্ব-৩)
জুবায়ের আহমেদ জীবন
(গত সংখ্যার পর)
রবীন্দ্র প্রতিভার জয়গানে বাংলা সাহিত্য যখন মুখরিত ঠিক তখনই সম্পূর্ন এক নতুন অথচ কালজয়ী প্রতিভা নিয়ে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে আবির্ভূত হন কাজী নজরুল ইসলাম। বক্তব্যের বলিষ্ঠতা, প্রকাশভঙ্গিতার স্বাতন্ত্র্য, ভাষা ও ছন্দের বৈচিত্র্য এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের প্রতি গভীর মমত্ব সব মিলিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য সাধারণ প্রতিভা। সেনাশিবিরে ব্যস্ততার মাঝেও তিনি সাহিত্যচর্চা চালিয়ে যান। করাচী থেকেই তিনি কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় তার লেখা পাঠান। তার প্রথম লেখা “বাউন্ডলের আত্মজীবনী” নামে একটি গল্প এবং প্রথম কবিতা “মুক্তি”। “মুক্তি” কবিতাটি তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের ট্রেঞ্চে বসে রচনা করেন।
কবি নজরুল তার সাহিত্যকর্মের লেখনীতে অগাধ পান্ডিত্যের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি সাহিত্যকর্মে প্রচুর লিখেছেন। কবিতা তো ছিলই আরো ছিল গান, গজল, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ইত্যাদি। তিনি শুধু বিদ্রোহী কবিই ছিলেন তা নয়; তিনি তার লেখনিতে বিদ্রোহী হওয়া, জুলুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বাঁচা ও চলার এবং আনন্দময়তার প্রতিভা উদ্ভাসিত করেছেন। তিনি অনেক বড় মনের অধিকারী ছিলেন; মনীষীও বটে। তাই বলে তিনি ছোটদের কথা ভুলেননি। আর ভুলনোইবা কি করে? অনেক বড় হৃদয় তার। সেই হৃদয়ে ছিল অগভীর ভালবাসা- স্নেহ- প্রীতি; যেন ভালবাসার মহাসমুদ্র। তিনি ভালবাসতেন মানুষ, দেশ, ধর্ম ও প্রকৃতিকে। আর ছোটরা ছিল খুব কাছের/ আপন। তাই তিনি ছোটদের জন্য লিখেছেন অসংখ্য কবিতা। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, তার সেই অসংখ্য ছোটদের জন্য লেখা কবিতাগুলোর মধ্যে খুব কম কবিতার সাথে আজকের ছোটরা পরিচিত। আচ্ছা, তিনি ছোটদের জন্য শুধু কবিতাই লিখেছেন? না, একদম না, তিনি ছোটদের জন্য গোটা গোটা প্রায় তেরোখানা বই লিখেছেন। এগুলোর মধ্যে ঝিঙে ফুল, সঞ্চয়ন, ঘুম জাগানো পাখি, ঘুম পাড়ানো মাসি- পিসি, ভোরের পাখি, জাগো সুন্দর, চির কিশোর, সাত ভাই চম্পা, তরুণের অভিযান, পিলে পচকা, পুতুলের বিয়ে, মটু মাইতি, ফুলে ও ফসলে প্রভৃতি। ‘পুতুলের বিয়ে’ নামক একখানা নাটিকাও তিনি রচনা করেন; যা ১৯৩৩সালে প্রকাশিত হয়। তাছাড়াও ‘ভূতের ভয়’, ‘ঝিলিমিলি’, ‘সঞ্চায়ন’ নামেও নাটক লিখেছেন।
শিশুদের জন্য লেখা ‘জিনের বাদশা’ ও ‘অগ্নিগিরি’ গল্প দু’টিতে তিনি তার কৈশোরের স্মৃতি মিশ্রিত করেছেন। শিশুদের উদ্দেশ্যে বিশেষভাবে রচনা করেন ‘কাব্য আমপাড়া’ ও ‘মক্তব সাহিত্য’ নামে দু’টি গ্রন্থ। ‘কাব্য আমপাড়া’ গ্রন্থটি পাঠ করে শিশু- কিশোর ছাড়াও সর্বসাধারণ উপকৃত হতে পারেন। এ বইটিতে তিনি সূরা ফাতিহাসহ ত্রিশ পাড়ার ৩৭টি- মোট ৩৮টি সূরার পদ্যানুবাদ করেছেন।
কাজী নজরুল ইসলাম তার লেখায় যে বিষয়টির দ্বারা মানুষকে আকৃষ্ট করেছিলেন তা ছিল মানুষের জন্য মমতা ও দায়িত্ববোধতা। সাহিত্য- সংস্কৃতিকে তিনি পরাধীন ভারতবর্ষে নির্যাতিত গণমানুষের বৈপ্লবিক চেতনার সাথে সম্পৃক্ত করেছিলেন। ‘শিল্পের জন্য শিল্পচর্চা’- কবি নজরুল একথা কোনো মতেই বিশ্বাস করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে, একজন সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি তার বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। যে কারণে অন্যান্য কবি- সাহিত্যিকদের মতো তিনি সরকার ও সমাজ থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থা করে সাহিত্য রচনা করেননি। তার বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বারবার। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি রাজনৈতিক নেতার মতোই প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন, কারাবরণ করেছেন। কারারুদ্ধতার বিরুদ্ধে উদ্ধত কন্ঠে গর্জে উঠেছেন-
“কারার ঐ লৌহকপাট
ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট
রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণ বেদী।”
অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, সর্বহারা, ভাঙ্গার গানসহ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে নজরুল সাম্রাজ্য ও অন্যায়- অবিচার- জুলুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। আবার কখনো নিদারুণ ব্যথায় অভিশাপ দিয়েছেন কর্কশ কন্ঠে-
“প্রার্থনা করো, যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্তে তাদের সর্বনাশ।” (চলবে)