
কবি নজরুলের জীবনকথা (পর্ব-৭)
জুবায়ের আহমেদ জীবন
(গত সংখ্যার পর)
কলকাতায় ফিরে গিয়ে নিজের ভুল বুঝে ও অনুতাপ প্রকাশের মাধ্যমে তাকে ভুল না বোঝার জন্য চিঠি লিখেন ফজিলাতুন্নেসাকে। এতে কবির প্রতি অভিযোগ ভোলার পরিবর্তে তাকে ব্যঙ্গ- বিদ্রুপ করেছিলেন। মোতাহার হোসেনকে লেখা চিঠি থেকে বোঝা যায় ফজিলাতুন্নেসার উল্টো ব্যঙ্গ- বিদ্রুপিত চিঠির ভাষা নজরুলের জীবনের স্বস্তি কেড়ে নিয়েছিল, ‘আঘাত আর অপমান এ দুটোর প্রভেদ বুঝবার মতো মস্তিষ্ক আমার আছে। আঘাত করবার একটা সীমা আছে; যেটাকে অতিক্রম করলে আঘাত অসুন্দর হয়ে ওঠে আর তখনই তার নাম হয় অবমাননা।’
কবিকে এরকম ব্যঙ্গ- বিদ্রুপ, অবমাননা করা সত্ত্বেও তিনি ফজিলাতুন্নেসাকে ভুলতে পারেননি। নিজের ভুলকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন বন্ধু মোতাহারকে লেখা চিঠিতে-
“কয় মূর্হুতে দেখা, তারি মাঝে তার কত বিরক্তিভাজন হয়েছি, হয়তবা কত অপরাধও করে ফেলেছি। পাওয়ার বেভুল আনন্দে কি করেছি না করেছি, কি লিখেছি না লিখেছি তা আমার মনে নেই আর কোনোদিন মনে পড়বেওনা।…. তার আঘাত বেদনা অশ্রু আমার শ্বাশত লোকের শূণ্য ভান্ডার পূর্ণ্য করে দিয়েছে।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রধান নলিনী মোহন বোসের প্রিয় ছাত্রী ছিলেন ফজিলাতুন্নেসা। তিনি অধ্যবসায়ী এই ছাত্রীকে নানাভাবে বুদ্ধি- পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতেন, যাতে বয়সসূলভ চঞ্চলতা তাকে বিপথে নিতে না পারে।
ফজিলাতুন্নেসা ড. বোসকে দেবতার আসনে বসিয়েছিলেন। আলাপ- পরিচয়ে প্রথম পর্বেই এই শিক্ষকের প্রতি তার অকুন্ঠ শ্রদ্ধার কথা তিনি নজরুলকে জানিয়েছিলেন। এ ব্যাপারটি কোনোভাবেই সহ্য করতে পারেননি তিনি। তার প্রেমাকাঙ্খা ও মিলনের ক্ষেত্রে এই লোকটিকে তিনি বড় বাধা মনে করতেন। মোতাহারকে লেখা চিঠিতে এই শিক্ষকের প্রতি বিষোদগার করতে ছাড়েননি তিনি, ‘কোন নারী সুন্দর, সুন্দরের উপাসিকা নারী কোন অঙ্কশাস্ত্রীর কবলে পড়েছে, এ আমি সইতে পারিনে। নারী হবে সুন্দরের অঙ্কলক্ষী, সে অঙ্কশাস্ত্রীর ভাড়ার রক্ষী হবে কেন?… আমি তাকে বলি প্রাণহীন যক্ষ। অকারণে ভূত্যের মতো রত্ন- মানিক আগলে বসে আছে। সে রত্ন কিন্তু গলায় নিতে পারে না, অন্যকেও নিতে দিবে না।’ ঈর্ষা তার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে একথা লিখতেও তিনি দ্বিধা করেননি- “এখন কেবলি মনে হচ্ছে কি ছাই করলুম কবিতা লিখে। তার চেয়ে অঙ্কের প্রফেসর হলে ঢের লাভবান হতে পারতাম।”
প্রত্যাখ্যানের বেদনা থেকে এ রকম শিশুর মতো অযৌক্তিক ও হাস্যকর কথাও লিখে ফেলতে পেরেছিলেন নজরুল- ‘আমি যদি বি.এ-টা পাশ করে রাখতাম তাহলে দেখিয়ে দিতাম যে, এম.এ- তে ফাস্ট ক্লাস কবিও হতে পারে ইচ্ছে করলেই।’
প্রথমবার ফজিলাতুন্নেসাকে যে চিঠি তিনি লিখেছিলেন তার রূঢ় উত্তরটারপর আর কখনো চিঠি লিখবার সাহস করে উঠতে পারেননি তিনি তবে দীর্ঘদিন বন্ধু কাজী মোতাহারের খোঁজ- খবর না পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন, এই উছিলায় তিনি আরেকটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিতে দেখা যায়, যথেষ্ট কুন্ঠা ও সমীহের সাথে ফজিলাতুন্নেসাকে ”আপনি” সম্বোধন করে কবি লিখেছেন- “আপনি দয়া করিয়া জানা থাকিলে আজই দুলাইন লিখিয়া তাহার খবর জানান, তাহা হইলে পরিশেষ কৃতজ্ঞ থাকিব।” কিন্তু ‘দয়া করিয়া’ যে ফজিলাতুন্নেসা এ চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন তার কোন সত্য হদিস আজো মেলেনি।
নজরুল তার নির্বাচিত কবিতার সংকলন সঞ্চিতা তাকে উৎসর্গ করার অনুমতি চেয়েছিলেন ফজিলাতুন্নেসার কাছে। কিন্তু তাতেও আপত্তি ছিল তার। সর্বশেষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বইটি উৎসর্গ করেছিলেন নজরুল। নজরুল বন্ধু মোতাহার হোসেনকে যে চিঠিগুলো পাঠাতো সে মন থেকে চাইত এই চিঠিগুলো ফজিলাতুন্নেসা পড়ুক। এক চিঠিতে লিখেছিলেন, “এ চিঠি শুধু তোমার এবং আরেক জনের। একে সিকরেড (ঐশ্বরিক) মনে করো। আরেকজনকে দিও দু’দিনের জন্য।”
কিছুকাল এই বিখ্যাত বেদনা তাকে জর্জরিত করেছিল। উচ্চশিক্ষার জন্য ফজিলাতুন্নেসা ইংল্যান্ড চলে গেলে ধীরে ধীরে এই ঘোর থেকে বেরিয়ে আসেন কবি। তবে আঘাত অপমানের জীর্ণ দিনগুলো বিফলে যায়নি। সাফল্য পেয়ে বাংলা সাহিত্য; অবিস্মরণীয় কিছু গান ও কবিতা সাহিত্য অঙ্গনকে করেছে আরো অলংকৃত। কোন এক মহানুভব যথার্থই বলেছিলেন, “দুঃখ আবিষ্কারের জননী”। নজরুলের সেই বাল্যকাল থেকে পাওয়া দুঃখ- বেদনা তাকে আবিষ্কারের মাধ্যমে স্মরণীয় করে রেখেছে এই ভবের ঘরে। (চলবে)
Post Views:
235