ছবি: রয়টার্স
সাব্বির আহমেদ, নিজস্ব প্রতিবেদকঃ করোনা ভাইরাসের গতিপ্রকৃতি এখনো ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারেনি কেউ। প্রতিটি সংক্রামক ব্যাধি ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এর গতিপ্রকৃতি পাল্টায়। ফ্লু সাধারণত শীতের সময় হয়। ঠিক করোনা ভাইরাসও যেমনটা এসেছে। অন্যদিকে টাইফয়েড আসে গরমে। এখন তাই অনেকের ভাবনা, শীতে শুরু হওয়া করোনা ভাইরাস তবে কি ঋতু পরিবর্তন অর্থাৎ, গরমে কমে যাবে?
গত বছরের মধ্য ডিসেম্বরে চীনে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাস দ্রুত ছড়ায় সারা দেশে। এখন চীন ছাড়িয়ে এ ভাইরাস ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে বিস্তার লাভ করছে। এখন পর্যন্ত যেসব অঞ্চলে করোনা বড় আকারে ছড়িয়েছে, সেসব শীতপ্রধান অঞ্চল এবং ঠান্ডা পরিবেশেই এ ভাইরাস বেশি ছড়িয়েছে। তাই করোনা ভাইরাস গরমে থাকবে কি না, এ প্রশ্ন ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।
আজ থেকে ১০ বছর আগে যুক্তরাজ্যের এডিনবরা ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ইনফেকশাস ডিজিজের কেট টেপ্লশেন তিন ধরনের করোনা ভাইরাসের নমুনা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। এসব নমুনা আক্রান্ত রোগীদের কাছে থেকে নেওয়া হয়েছিল। এদের সবারই শ্বাসযন্ত্র আক্রান্ত হয়েছিল। সব ক্ষেত্রে ভাইরাসে আক্রান্তের সময় ছিল ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাস। Lifebuoy Soap সারা বিশ্বের ৫০০টি এলাকার নমুনা নিয়ে একটি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এটি এখনো অপ্রকাশিত বলে বিবিসির একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে ভাইরাসটির বিস্তারে তাপমাত্রা, বাতাসের গতি ও তুলনামূলক আর্দ্রতার সম্পর্ক আছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
‘উইল ওয়ার্ম ওয়েদার রিয়েলি কিল অফ কোভিড-১৯’ শিরোনামে বিবিসির প্রতিবেদনটিতে আরও একটি অপ্রকাশিত গবেষণার সূত্র উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে গবেষকেরা অনুমান করেছেন, বিশ্বের উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের দেশগুলো করোনা ভাইরাসের কারণে কম আক্রান্ত হবে। স্টকহোমের ক্যারোরিনসকা ইনস্টিটিউটের ভাইরাস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জেন আলবার্ট বলছেন, ‘আমরা আশা করছি যে করোনা ভাইরাস শেষ পর্যন্ত স্থানীয় একটি মহামারি হিসেবে চিহ্নিত হবে। আর এটি যদি ঋতুর সঙ্গে পরিবর্তিত না হয়, তবে তা হবে বিস্ময়কর। আমরা নিশ্চিত করে এখনো জানি না। তবে এটা সম্ভব।’ করোনা ভাইরাস যে ভাইরাস গোত্র থেকে এসেছে, তাকে বলা হয় ‘এনভেলাপড ভাইরাস’। এর অর্থ হলো, এ ভাইরাসের গায়ে তৈলাক্ত একধরনের প্রলেপ থাকে। ঠান্ডায় এই তৈলাক্ত প্রলেপ আরও শক্ত হয়ে ওঠে। ঠিক রাবারের মতো। মাংস রান্না করার পর ঠান্ডা হয়ে গেলে চর্বি যেমন হয়, এ ক্ষেত্রেও তেমনটি হয়।
বিশ্বব্যাপী মহামারি হয়ে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসকে আমরা সাধারণভাবে করোনা বলছি বটে, কিন্তু এ থেকে সৃষ্ট রোগের নাম কোভিড-১৯। কিন্তু বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাছে এটি সার্স কোভিড–২ নামে পরিচিত। আগে ছড়ানো সার্স ভাইরাসের সঙ্গে সামঞ্জস্য লক্ষ করেই এমন নামকরণ হয়েছে।
করোনা ভাইরাসের সঙ্গে সম্পর্ক আছে, এমন একটি ভাইরাস সার্স। ২০০৩ সালে সার্স মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার সময় দেখা যায়, ভাইরাসটি শীতল ও শুষ্ক পরিবেশে বেশি ছড়ায়। সেটি ২২ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় অন্তত পাঁচ দিন পর্যন্ত থাকত। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা যত বেড়েছে, সার্সের জীবনও তত স্বল্পায়ু হয়েছে। স্পেনের মাদ্রিদের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল সায়েন্সের গবেষক মিগুয়েল আরুজোর বক্তব্য, মানুষের শরীরের বাইরে ভাইরাসের স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে জলবায়ু অবশ্যই একটি ভূমিকা রাখে। সার্স কোভিড-২ (করোনা ভাইরাস) বিশ্বের যেসব অঞ্চলে এবার দ্রুত ছড়িয়েছে, তার সবই শীতপ্রধান এলাকা।’
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা ভাইরাস এবার সেসব অঞ্চলেই বেশি ছড়িয়েছে, যেসব অঞ্চলে গড় তাপমাত্রা ৫ থেকে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবার এসব এলাকায় আর্দ্রতাও কম। এতেই কি বলে দেওয়া যায় যে করোনা ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে তার পথ পরিবর্তন করবে না বা উষ্ণ অঞ্চলে ছড়াবে কম মাত্রায়? এর উত্তর হলো, না। এখনো তা বলার সময় আসেনি। বরং অপেক্ষাকৃত উষ্ণ এলাকায় ছড়ানোর রেকর্ড আছে। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের একদল গবেষক এশিয়ার দেশগুলোতে এই মহামারির বিস্তার নিয়ে কাজ করছেন। তাঁদের কথা, উষ্ণ অঞ্চলে ছড়াবে না বলে যে আশা করা হচ্ছে তা আসলে ক্ষীণ। তাঁরা উদাহরণ দিয়েছেন চীনেরই, যেখানে এ ভাইরাসের প্রথম প্রাদুর্ভাব। তাঁরা বলছেন, চীনের হুবেই প্রদেশের উহানের আবহাওয়া ঠান্ডা, তাতে সন্দেহ নেই। উহান থেকে এটি জিলিন ও হেলংজিংয়ে গেছে, সেখানেও ঠান্ডা ছিল। কিন্তু গুয়াংজি বা সিঙ্গাপুরের মতো উষ্ণ এলাকাতেও করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে। তাই তাদের কথা হলো, আসলে এ ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে মূল দরকারি জিনিসটা হলো বিস্তার রোধ। দূরত্ব সৃষ্টি। এর জন্য চাই, জনস্বাস্থ্য বিষয়ে ব্যাপক উদ্যোগ। যেগুলো এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে তাঁরা একটি উদাহরণ দিয়েছেন। ইউরোপে হামের বড় বিস্তারের পরে দেখা গেছে, স্কুল বন্ধ থাকার সময় এর বিস্তার কম হয়েছে। ২৫ জানুয়ারি চীনের চান্দ্র নববর্ষের দিন নিজ এলাকায় ফেরার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। আর এর ফলেই উহান থেকে এটি দেশটির অন্যত্র এবং পরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তবে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনার বিষয়ে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের এক অপ্রকাশিত গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, অপেক্ষাকৃত বেশি ঠান্ডার সময় মৃত্যুর হার বেশি হয়েছে। এটা অবশ্য কম্পিউটার মডেলিংয়ের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। করোনা ভাইরাস একেবারে নতুন। এর গতিপ্রকৃতি এখনো ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারেনি কেউই।
তবে ফ্রান্সের ইনস্টিটিউট অব হেলথ অ্যান্ড মেডিকেল রিসার্চের পরিচালক ভিক্টোরিয়া কোলিৎজারের কথা হলো, বিমান পরিবহনে এ ভাইরাস এবার সারা বিশ্বে এত দ্রুত ছড়িয়েছে। আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন যোগাযোগব্যবস্থা অনেক উন্নত। এর বিস্তারও তাই এত দ্রুত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ভিন্ন মৌসুমে ভিন্ন আচরণ করবে কোভিড-১৯; তা বলার মতো এখনো সময় আসেনি। তবে ভাইরাসের গতিপ্রকৃতি মৌসুমের পরিবর্তনে পরিবর্তিত হতেই পারে।