করোনাভাইরাস: ধর্মীয় গলদ, ভ্রান্ত মতবাদ
-জুবায়ের আহমেদ জীবন
বর্তমান সময়ের আতঙ্কিত ও বহুল আলোচিত বিষয় হচ্ছে করোনাভাইরাস। রীতিমতো অনেকেই নামটি শুনলে ধাক্কা খান। খাওয়ারি কথা, যে পরিমাণে আক্রান্ত আর মৃত্যের সংখ্যা বাড়ছে তাছাড়াও ইতোপূর্বে চীনে যে তান্ডবলীলা চালিয়েছে। এখন আবার ইতালি, স্পেন, ফ্রান্সসহ বিশ্বমোড়ল আমেরিকাতেও তার লেলিহান রূপে দেখে বিশ্ব ‘থ’ বুনে গেছে। জনজীবন চরমভাবে বিপর্যস্তের মুখে নিপতিত। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে লকডাউন ঘোষণার মাত্র ক’দিনে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে; গোটা ভারত জুড়ে এখন শুধু হাহাকার! বাংলাদেশেও প্রায় একই অবস্থা। অঘোষিত লকডাউনেই মানুষের জীবনমানের প্রায় কুপোকাত অবস্থা।
করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য বিশ্বের উচ্চ মানের গবেষক, চিকিৎসক, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাকাল অবস্থা। আর বাংলাদেশের নানা হুজুগে গুরু এর প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছে বলে একেবারেই ঢাক- ঢোল পেটাচ্ছে। রটাচ্ছে নানান আজগুবি সব গুজব। কেউ কেউ আবার করোনা নামের বিশ্লষণও করে ফেলেছে। বেশ কিছুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা সবার নজর কেড়েছে; করেছে জনমনে ধর্মীয় ভীতির সঞ্চার। ইতিহাস বলে বাঙ্গালি ধর্মভীরু জাতি; ধর্মীয় বাণী শুনলেই তারা এক নিঃশ্বাসে বিশ্বাস করে নেয়; বাচ- বিচার করার সময় কোথায়! এই অন্ধ বিশ্বাস যে তাদের ধর্মীয় গোঁড়ামির দিকে ঠেলে দিচ্ছে সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নাই।
“করোনা” শব্দটির বিশ্লষণাত্মক পূর্ণ নামকরণ একেক ধর্মালম্বীরা একেকভাবে করেছে। যেহেতু পৃথিবীতে সব ধর্মই একসাথে সত্য, সঠিক হওয়া সম্ভব নয় সেহেতু সকলের করোনা বিশ্লেষিত নামও সঠিক নয়। ইসলাম ধর্মালম্বীরা বলছে, “করোনা”র ক= কোরআন, রো= রোজা এবং ন= নামায; যার পূর্ণার্থ ‘কোরআন, রোজা, নামাজ পড়’। অন্যদিকে সনাতন (হিন্দু) ধর্মালম্বীরা বলছে, ‘ক= কৃষ্ণ, রো= রাধা এবং ন= নাম/ নারায়ণ’; যার পূর্ণার্থ ‘কৃষ্ণ- রাধা নাম জপ’। এটা তাদের একান্তই মনগড়া কারণ “করোনা” শব্দটি হচ্ছে ল্যাটিন শব্দ, যার বাংলা অর্থ হচ্ছে মুকুট। আমাদের দেশীয় কতিপয় ব্যক্তিবর্গ তথা যারা এই ‘করোনা’ শব্দটিকে ভেঙ্গে- মুচড়ে নিজের চিন্তাকে জাহির করতে চায় তারা একটি বারও লক্ষ্য করলনা যে ভাইরাসটির উৎপত্তি আমাদের দেশে নয় আর এর নামকরণ করা হয় কিছু নিদির্ষ্ট নিয়ম মেনে। তারা ভাবলনা যে, ভাইরাসটির উৎপত্তি যেখানে সেখানে তারা তাদের ভাষার অর্থবোধকতার সাথে মিল রেখেই এর নামকরণ করবে (যেমনটি আমরা বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করেছি- আইলা, হারিকেন, নার্গিস প্রভৃতি)। আমি ধর্মের বিরুদ্ধাচার করছিনা বরং অন্ধ ধার্মিকতার বিরুদ্ধে সমালোচনা করছি। আমরা যারা বাংলা ভাষাভাষীর লোক তারা নাহয় এই “করোনা”র অনুবাদ বুঝলাম কিন্তু বিশ্বের বাকিরা? তাদের জন্যে এতে সৃষ্টিকর্তা কোন ইঙ্গিত দেয়নি? শুধু কি নিদির্ষ্ট করে বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য তার প্রার্থনা করার ইঙ্গিত বা ইশারা দিয়েছেন? নিশ্চয় নয়, কারণ সৃষ্টিকর্তা কখনোই পক্ষপাতিত্ব করেন না; তিনি গোটা পৃথিবীর মানুষকে ‘করোনা’ দিয়ে মেরে আবার শুধু নিদির্ষ্ট ভাষাভাষীদের জন্য ঐশী ঈশারা দিবেন তা কিভাবে হয়! ‘করোনা’ একক নাম না, সম্পূর্ণ নাম ‘করোনাভাইরাস’। গলদপূর্ণ চিন্তা নিয়ে শুধু ‘করোনা’র বিশ্লেষণ করলেন কিন্তু ‘ভাইরাস’ শব্দটিকে তার কোন অংশেই যুক্ত করলেননা এটা কতটা যৌক্তিক?
২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহান শহরে করোনাভাইরাসের একটি প্রজাতির সংক্রমণের দেখা দেয়। যাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘২০১৯ এনসিওভি’ নামকরণ করে। করোনা ভাইরাস হচ্ছে আদর্শ প্রজাতির। সকল প্রকার করোনা ভাইরাসে চার ধরণের প্রোটিন দেখা যায়।
“করোনাভাইরাস” নামটির উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ “করোনা” থেকে যার অর্থ ‘মুকুট/ হার’। করোনা শব্দটি নিজে গ্রিক শব্দ κορώνη korṓnē থেকে এসেছে যার অর্থ “মালা” বা “হার”। কারণ দ্বিমাত্রিক সঞ্চালন ইলেকট্রন অনুবীক্ষণ যন্ত্রে ভাইরাসটির আবরণ থেকে গদা- আকৃৃৃৃতির প্রোটিনের কাঁটাগুলির কারণে এটিকে অনেকটা মুুুকুট বা সৌর করোনার মতো দেখায়। এরপর আর করোনার নাম নিয়ে গলদ থাকে না।
লেখকঃ ছাত্র, একাদশ শ্রেণি, মানবিক বিভাগ; কাঞ্চন নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজ, বিরল, দিনাজপুর।
Post Views:
239