এম আজম, দিনাজপুরঃ বৈষিক মহামারি করোনা ভাইরাসের তান্ডবে স্থবির হয়ে পড়েছে বিশ্ব। বিশাল বিশাল আগ্নেয়াস্ত্র, ক্ষমতার প্রভাব প্রতিপত্তি হার মানতে বাধ্য হয়েছে অণুজীব কোভিড-১৯ এর কাছে। এ যেন পিঁপড়ের কাছে হাতির পরাজয়। বিশ্ব মোড়ল আমেরিকাও দিশেহারা, হণ্যে হয়ে উঠে পড়ে লেগে প্রতিষেধক আবিষ্কারে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা।
৮ই মার্চ দেশে করোনা শনাক্তের পর জনমনে আতঙ্কের ছাপ কেটে যায়। কর্মচঞ্চলতায় কিছুটা ধীর গতি নেমে আসে। অতঃপর সারাদেশ লকডাউন ঘোষণা করা হয়। করোনা সংক্রমণ এড়াতে ১৭ই মার্চ হতে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর কেটে গেলে কত মাস, কত দিন তবুও শিক্ষাঙ্গন ফিরে পেলোনা কমলমতি শিক্ষার্থীদের হৈচৈয়ে মুখোরিত ক্যাম্পাস। শিক্ষার্থীরা গৃহবন্দী থাকায় হাঁপিয়ে উঠেছে। কিন্তু এই গৃহবন্দী হওয়া ছাড়া কিইবা করার!
আর কত করোনার সাথে লুকোচুরি, আর কত গৃহবন্দী আবাস, কতইবা বন্ধু- পরিজন বিহীন তিক্ত জীবন? করোনার প্রকোপে এহেন কঠোর বিধি-বিধি-নিষেধে শিক্ষার্থীরা কেমন দিন কাটাচ্ছে, তাদের পড়াশোনার খবর কি? কে জানে ঘরে বসে তারা করছেটা কি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্বের ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীরা করোনা প্রকোপে পড়াশোনা বিমুখ। প্রতিবেদনের এমন ফলাফল যে ভবিষ্যতে ভালো কিছু ফল দিবেনা তা সকলের বোধগম্য। বিশ্বের যদি এই অবস্থা হয় তাহলে আমাদের মধ্যবিত্তের দেশের কি অবস্থা, সত্যিই বেশ আগ্রহ তৈরি করে।
এ নিয়ে সম্প্রতি ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অব গর্ভন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের ওপর গবেষণা চালিয়ে একটি ওয়েবিনারে গবেষণার ফল প্রকাশ করেছে। গবেষণাটিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. নিয়াজ আসাদুল্লাহ, বিআইজিডি’র সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট অনিন্দিতা ভট্টাচার্য, রিসার্চ অ্যাসেসিয়েট মনতাজিমা তাসনিম এবং রিসার্চ ইন্টার্ণ ফারজিনা মুমতাহেনা। বাংলাদেশের শহরের বস্তি ও গ্রাম্য এলাকার ৫ হাজার শিক্ষার্থীর ওপর এ গবেষণাটি করা হয়। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সময় ৮০ শতাংশ কমেছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। বিআইজিডির তথ্য মতে, আগে যেখানে গ্রামের শিক্ষার্থীরা দিনে স্কুল, কোচিং ও বাড়িতে নিজেদের পড়ালেখা মিলে ১০ ঘণ্টা ব্যয় করত। এখন তা নেমে এসেছে মাত্র ২ ঘণ্টায় অর্থাৎ ৮০ শতাংশ সময় পড়াশোনা কমেছে। গবেষণায় দেখা যায়, মাত্র ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী টেলিভিশনে ‘ঘরে বসে শিখি’ ও ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ এ দুই অনুষ্ঠান দেখছে এবং মাত্র ১ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইনে ক্লাস করছে। গবেষণাটিতে আরো একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের এই সময় পড়াশোনার সনয় হ্রাসের বিপরীতে বেড়েছে শিশুশ্রম।
এদিকে করোনাকালীন ছুটিতে শিক্ষার্থীরা অবসর সময় কাটাতে অতিরিক্ত ইন্টারনেট আসক্ত হয়ে পড়েছে। অবসর সময়ে একাকিত্ব ঘুচাতেই তাদের ইন্টারনেট মুখি হওয়া বলা ধারণা করা হচ্ছে। সত্যি কি এটা ধারণা নাকি বাস্তবতা? হ্যা, এটাই বাস্তবতা। দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া হয়না, বন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎ নাই, একসাথে আড্ডা দেওয়া হয়না, পরিজনদের সাথে একই অবস্থা এহেন আত্মীক দূর্গতি এড়াতে তারা ঝুঁকে পড়তে প্রযুক্তির দিকে। ইন্টারনেট আসক্তি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বিষয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন করে তুলছে। শুধু কি তাই? না, শুধু তাই নয়, সেই সাথে শিক্ষার্থীদের মাঝে নিঃসঙ্গতা- একাকিত্বের অনুভূতিও বেশ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে কম্পিউটার অ্যাসোসিয়েড লার্নিং জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদে উল্লেখ করা হয়।
বিআইজিডি প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে ১ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইনে ক্লাস করা বিষয়টি সত্যিই বেশ উদ্বেগের। ভাববার বিষয়ও বটে। অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের হতাশাজনক উপস্থিতি ভবিষ্যতে যে ভাল কোন ফল বয়ে আনবেনা তা নিশ্চিত। কিন্তু শিক্ষার্থীদের এমন বিশালায়তনের অনুপস্থিতির কি কারণ থাকতে পারে সে বিষয়ে বেশ মতবিরোধ রয়েছে।
Post Views:
220