বাংলা সাহিত্য আজ আধুনিকতার চরম উৎকর্ষতায় পৌঁছেছে। সাহিত্যের ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে। নতুন কবি, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিকের উদয় হয়েছে, উত্থিত হয়েছে নব্য সাহিত্য ও সাহিত্যরস। চর্যাপদ আবিষ্কারের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস উন্মোচিত হয়েছে। দিন বদলের পাল্লায় সাহিত্যেরও নানা পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কালপরিক্রমায় সাহিত্য তার রূপ পাল্টাচ্ছে, সাহিত্যিক হচ্ছেন আধুনিক(morden)। তাদের কলম বিকলাঙ্গ, অবশ ও মরিচিকাময় চিন্তাধারা। চিন্তাজগত ক্ষণ, বস্তুবাদীতা তাদের চিন্তাশক্তিকে আড়ষ্ঠ করেছে। আধুনিকতার নামে পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুসরণ, অনুকরণের গোলামীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ কলম। সাহিত্যজগতের সম্রাটেরা সংস্কৃতিরচর্চা, প্রসারতা, জনমনে পৌঁছানোর নিয়ন্ত্রক। সাহিত্যধারার প্রবাহবেগ নিয়ন্ত্রণ তাদের দায়িত্ব। কিন্তু কোন ধারায় প্রবাহিত করছেন আমাদের সাহিত্য, আমাদের সংস্কৃতি? নিশ্চয়ই এর জবাবে সুধীমহল বলবেন না যে, আধুনিকতার পান্থে। কারণ আমাদের সাহিত্য আজ আমাদের মুক্তি দেয় না বরং আড়ষ্ঠ করছে জ্ঞানকে, নিবৃত করছে প্রতিভাকে।
কাল কতক একট বিষয় চিন্তাজগতে ফোকাসিং হচ্ছিল আমাদের সাহিত্যে প্রেম- পরিণয় বিশেষ করে পরকিয়ার কথা খুব চর্চা হচ্ছে। কিন্তু কেন? কারণ পাশ্চাত্য সাহিত্য, সংস্কৃতির অনুসরণ, অনুকরণ। যার ফল পারিবারিক, সামাজিক সম্প্রীতিক সংঘাত। আর দিনকে দিন তা সংঘাত থেকে সংঘাতময় অাকার ধারণ করছে। আমার পরিচিত এক সম্ভ্রান্ত পরিবার এর ভুক্তভোগী। আধুনিকতার দোহাই দিয়ে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি লালন করে অবশেষ আজ এক অসহায় পিতার ভূমিকা পালন করছেন সেই পরিবারের কর্তা। তার যশ- খ্যাতি, ক্ষমতা সবি আছে শুধু পারিবারিক সম্প্রীতি আর মানসিক প্রশান্তি ব্যতিরেক। এরকম লাখো ভুক্তভোগি আছে যারা একেবারে অসহায়ত্বের শৃঙ্খলে গ্রেফতার হয়ে অশান্তির আধারে নিপোতিত।
আমাদের বীর্যবন্ত সাহিত্য চাই। যে সাহিত্য সত্যিকার মুক্তি দিবে- দেহের মুক্তি, আত্মার মুক্তি, মনের মুক্তি। এই তিনটিকে নিয়েই মানুষ, যার একটিকে ছেড়ে অন্যটির মুক্তি নেই। আলঙ্কারিক মম্মট ভট্ট কাব্যের ফল সম্বন্ধে বলেন-
কাব্যং যশসেহর্থকৃতে ব্যবহারবিদে শিবেতরক্ষতয়ে।
সদ্যঃ পরনিবৃর্তয়ে কান্তাসম্মিততয়োপদেশযুজে।।
‘কাব্য যশের জন্য, টাকাকড়ির জন্য, আচার- ব্যবহারের জন্য, অমঙ্গল দূর করবার জন্য, সদ্য সদ্য পরম শান্তি লাভের জন্য, প্রেয়সীর ন্যায় উপদেশ দিবার জন্য।’ সে সাহিত্য একেবারেই বিফল যা মুক্তি দেয় না। জাতির যৌবন শক্তিকে এই পরাড়ষ্ঠ সাহিত্য জোঁকের মতো চুঁষে নিঃশেষ করে নিস্তেজ করে দিচ্ছে।
হিন্দু সাহিত্য প্রেরণা পাচ্ছে বেদ- বেদান্ত,গীতা, হিন্দু ইতিহাস, হিন্দু মনীষী জীবনী থেকে আর তা রচিতও হচ্ছে গীতা, রামায়ণ, বেদ, মহাভারতের আলোকে। মুসলিম সাহিত্যেরও প্রেরণার বাতিঘর কোরআন, হাদিস, মুসলিম ইতিহাস, মুসলিম মনীষীদের জীবনী। কিন্তু পাশ্চাত্য সাহিত্যের পদাবলম্বন আর সংস্কৃতির ধারনে আত্মহংকার, দম্ভ হিন্দু-মুসলমানদের মাঝে সাম্প্রতিক সম্প্রীতি ক্ষুণ্ন করছে। বাংলা সাহিত্যবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র মতে- ‘হিন্দুর সাহিত্য রস সংগ্রহ করে হিন্দুসমাজ থেকে, আমাদের সাহিত্য করবে মুসলিমসমাজ থেকে। এই সাহিত্যের ভিতর দিয়েই বাংলার হিন্দু-মুসলমানের চেনা-পরিচয় হবে। চেনা হলেই ভাব হবে। To know is to love.’ দীনেশ বাবু বলেছেন, ‘যদি মুসরমানগণ তাঁহাদের সমাজের উন্নত চরিত্রগুলি সুন্দর মহিমান্বিত বর্ণে চিত্রিত করিয়া বাংলা সাহিত্যে উপস্থিত করেন, তবে হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে তাঁহাদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হইবেন।’ বাস্তবে বাংলা সাহিত্য হিন্দু-মুসলমানের অক্ষয় মিলন-মন্দির হবে। নিছক সাম্প্রতিক দাঙ্গার ভয় দেখিয়ে স্বার্থান্বেষী মহল তাদেন ফায়দা লুটতে ব্যর্থ হবে।
সাহিত্যিক কর্তাগণ যদি সাহিত্যকে সঠিকমাত্রায় রূপদান করতে পারে তাহলে জাতি তথা উঠতি যুবা-রা সঠিক পথের সন্ধান লাভে সক্ষম হবে। নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চায় প্রলুব্ধ হবে।
Post Views:
424